মুহতামিমে দারুস সালামের বাণী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য, যিনি আমাদেরকে দ্বীনের পথে কাজ করার তৌফিক দান করেছেন। দারুস সালাম কওমি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আমাদের এই মাদ্রাসা কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জনের একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানে আমরা শুধু জ্ঞান প্রদান করেই থেমে থাকি না; বরং শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, যাতে তারা ইসলামের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয়।
দারুস সালাম কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজে শিক্ষা, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়াচ্ছে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা একটি নুরানি বিভাগও চালু করছি, যা আগামী প্রজন্মের মৌলিক কুরআন শিক্ষা নিশ্চিত করবে, ইনশাআল্লাহ।
এক সময়ের প্রবাদ ছিল ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। বর্তমানে অনেকেই পরিবর্তন করে বলেন, শুধু শিক্ষা নয়; বরং ‘সুশিক্ষাই হল জাতির মেরুদন্ড’। আমি তাদের সাথে একমত। একথা সুস্পষ্ট যে, সকল শিক্ষার মাঝে একমাত্র কুরআন কারীমের শিক্ষাই হল আদর্শবান সুশিক্ষা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَه.
‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি,যে কুরআন মাজীদ শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়।’ (বুখারি শরীফ ২/৭৫২, হাদীস-৪৮৩৬)
কুরআনি শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি শুধু বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারাই নয়; বরং কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও অন্যান্য হাদীস শরীফ দ্বারাও প্রমাণিত। এ শিক্ষা (ইলম) অর্জন করাকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন তাঁর পবিত্র বাণীতে। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন,طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘দ্বীনি ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।’ (ইবনু মাজাহ, হাদীস-২০)
ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও আন্তর্জাতিক পর্যায়সহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে সফলতা লাভের জন্য দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের বিকল্প নেই। তাই এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে ভারতের দেওবন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কওমি মাদরাসার প্রাণকেন্দ্র ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’।
ভারতবর্ষকে ইংরেজ-বেনিয়াদের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করার সর্বপ্রয়াসী সংগ্রাম নিয়ে ১৮৫৭ সালে উলামায়ে হিন্দের নেতৃত্বে যে ‘সিপাহি বিপ্লব’ সংঘটিত হয়, তাতে দুঃখজনকভাবে মুসলমানরা পরাজিত হলে মুসলিম সমাজের উপর নেমে আসে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পৈশাচিক নির্যাতন ও অকল্পনীয় নিপীড়ন। হিংস্র ও জালিম ইংরেজরা শুধু শারীরিক নির্যাতনেই ক্ষান্ত ছিল না; বরং মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা,সভ্যতা-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করতে আঘাত হানে ইসলামি শিক্ষানীতির উপরও। তারা প্রণয়ন করে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা,যা শিখে মুসলিম জাতি রক্তে-মাংসে ভারতীয় হলেও চিন্তা-চেতনায় হয়ে উঠবে নাস্তিকবাদী কালচারের খাঁটি ইউরোপীয়। সময়ের সে ক্রান্তিলগ্নে বৃটিশদের শিক্ষার বিষফল থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষার পাশাপাশি তাদের ঈমান-আক্বীদা ও তাহযীব-তামাদ্দুনের হেফাযত এবং ইসলাম বিদ্বেষী মতাদর্শের মোকাবেলায় মুসলিম জনবলকে সংঘবদ্ধ করার সুমহান লক্ষ্যে ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ‘আযাদি আন্দোলনের’তৎকালীন সেনাপতি ও ‘সিপাহি বিপ্লবের’অন্যতম সিপাহসালার হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ.এর পরামর্শক্রমে, ঐতিহাসিক ‘শামেলিী যুদ্ধের’ বীর সেনাপতি হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. ও সমকালীন উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ যাবৎ দীর্ঘ দেড়শত বছরে সে সকল আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য দারুল উলূমের কৃতিসন্তানরা যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, তাতে এশিয়া মহাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠেছে দারুল উলূমের আদর্শের প্রতীক শত-সহস্র কওমি মাদরাসা। জামিয়া সাহবানিয়া দারুল উলূমও সে দেওবন্দ বৃক্ষেরই একটি ফল এবং তারই ধারাবাহিকতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
এ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব কোনো সিলেবাস বা গবেষণা কৈন্দ্রিক নয়;বরং দারুল উলূম দেওবন্দেরই পদাঙ্ক অনুসারী এবং সে সকল আকাবিরদের তৈরি তা’লীম,তারবিয়াতের নীতিমালার উপরই প্রতিষ্ঠিত। এ রিসালায় বর্ণিত সিলেবাসসহ যাবতীয় নীতিমালা মূলত তাঁদেরই প্রণীত নীতিমালার অনুসরণ,যে নীতিমালা ও সিলেবাস আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত বাণী থেকে নির্গত।
هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِيْ الْأُمِّيِّيْنَ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ آيَاتِه وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتبَ وَالْحِكْمَةِ
‘মহান আল্লাহ তা’আলা নিরক্ষর জাতির মাঝে তাদেরই একজনকে রাসূলরূপে পাঠিয়েছেন,যিনি মানুষকে কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে শুনাবেন,তাদের আত্মশুদ্ধি করাবেন এবং তাদেরকে কুরআন ও হিকমত তথা হাদীস শিখাবেন।’(সূরা জুমু’আ,আয়াত : ২)
বর্ণিত আয়াতটি কুরআন কারীমের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত,কুরআন ও হাদীসের ইলম তথা ইলমে দ্বীন শিখানো এবং সে অনুযায়ী আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে।
কুরআনের এ হেদায়াত মোতাবেক ইলমে দ্বীন শেখা ও শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় ভাষা আরবি, উর্দু,ফারসি জানার পাশাপাশি অন্যের কাছে ইলমে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখার প্রয়োজনীয়তাও ফুটে ওঠে। ভীনদেশি ভাষা বোঝার জন্য তা শিখতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবি হযরত যায়েদ বিন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এসেছে,
أَمَرَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَتَعَلَّمّ السُّرْيَانِيَّةَ. وَفِيْ رِوَايَةٍ أَنَّه أَمَرَنِيْ أَنْ أَتَعَلَّمَ كِتَابَ يَهُوْدَ إلخ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সুরয়ানি (হিব্রু) ভাষা শেখার আদেশ করলেন। অন্য বর্ণনা মতে,আমাকে ইহুদিদের পত্রলিখন পদ্ধতি শেখার আদেশ করলেন।’ (তিরমিযি,মেশকাত শরীফ,পৃষ্ঠা নং-৩৯৯)
তাই সময়ের চাহিদা পূরণে,বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম নিজেদের দীর্ঘ গবেষণা ও পরামর্শের মাধ্যমে একটি কার্যকর,যুগোপযোগী সিলেবাস ও গঠনতান্ত্রিক নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। যাতে কুরআনের হেদায়াত ও আকাবিরে দেওবন্দের মূলনীতি ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় ভাষাসমূহের সমন্বয় করা হয়েছে। জামিয়া সাহবানিয়া যুগোপযোগী সে সিলেবাসেরই অনুসরণ করে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব পরিসরে জামিয়া পর্যায়ের কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশব্যাপী বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা তৈরির ফিকির নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে ২০ বিঘা জায়গার উপর শাখা প্রতিষ্ঠান হিসাবে (বর্তমানে যার সাড়ে ৬ বিঘা কেনা হয়েছে) একটি জামিয়া (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া ঢাকার অভ্যন্তরে মিরপুর শেওড়াপাড়ায় একটি ‘মাদরাসাতুল বানাত’ প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
নববি আদর্শে আদর্শবান হতে এবং আকাবিরদের পথে চলতে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সাহায্য ও সফলতা দান করবেন বলে আমরা আশাবাদী।
আপনাদের দোয়া, সহযোগিতা ও সমর্থনই আমাদের পথচলার পাথেয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই প্রচেষ্টাকে কবুল করুন এবং দারুস সালাম কওমি মাদ্রাসাকে দ্বীনের খেদমতে একটি উজ্জ্বল মশাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
হে আল্লাহ,আপনি তাওফীক দান করুন।
শুকুরগুজার___
হযরত ক্বারী হাফেজ মাওলানা আহমদুল্লাহ সাহেব
মুহতামিম (প্রিন্সিপ্যাল)
দারুস সালাম ক্বওমী মাদ্রাসা
হযরত ক্বারী হাফেজ মাওলানা মুফতী আহমাদুল্লাহ
ছাত্র ও খলিফা : হযরত আল্লামা নূর হোসেন কাসেমী সাহেব (রহমাতুল্লাহি আলাইহ) ও হযরত হাফেজ মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস (দাঃ বাঃ)
ইফতা : মারকাযুল ফিকরি ওয়াদ দাওয়াহ (মানিক নগর, ঢাকা)
দাওরায়ে হাদীস : জামিয়া মাহমুদিয়া ইসহাকিয়া মাদ্রাসা (মানিক নগর, ঢাকা-১২০৩)।
শিক্ষক ইফতা বিভাগ : মারকাযুল ফিকরি ওয়াদ দাওয়াহ।
হিফজ : তাহফিজুল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ মাদ্রাসা।
মুহতামিম : দারুস সালাম ক্বওমী মাদ্রাসা (নিচুকাতিলা, বাগমারা, রাজশাহী।